বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৩

অনেকে দিয়েছে সব। সবাই দিয়েছে অনেক।

অনেকে দিয়েছে সব। সবাই দিয়েছে অনেক।


বেশ কিছুদিন আগে একটা স্টেটাস দিয়েছিলাম, যেকোনো বিষয়ে আমাদের চূড়ান্ত নেগেটিভিটি দেখানো এবং ব্যক্তিগত আক্রমন করার স্বভাব নিয়ে। একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিরক্তির বহির্প্রকাশ ছিল সেখানে। খেয়াল করলাম, অনেকেই আমার কথাগুলোর সাথে সহমত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন এটা নিতান্তই একটা ইউজুয়াল এন্টাগনিস্টিক স্টেটাস, আবার কেউ কেউ একটু ব্যঙ্গ করে ক্রিটিসাইজও করেছেন। সবচাইতে ভালো লাগলো একদল মানুষকে দেখে যারা এই হতাশার শেষে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন। যারা প্রত্যেকেই হয়ত আমার মতই হতাশ, তবু তারা কিছু একটা করার জন্য টগবগ করে ফুটছেন। আমার এই স্টেটাসটা তাদের জন্য। 

চলুন, একটা রিয়ালিটি চেক করি। বড়-বড় প্রমিসের বুলি না কপচে ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলি, আসলেই কিছু ভালো কাজ করার জন্য কে কতখানি সময় দিতে পারবে। দেখেন ভাই, সবার'ই ফ্যামিলি আছে, পড়াশোনা-চাকরি-ব্যবসা আছে। সবকিছু সামলে বিশাল একটা সময় ব্যয় করা হয়ত আমাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব না, কিন্তু অল্প কিছু সময় মনে হয় আমরা সবাইই দিতে পারি, তাই না? অনেক আগে একটা মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনের জন্যে একটা লাইন লিখেছিলাম "অনেকে দিয়েছে সব। সবাই দিয়েছে অনেক। আর তাই আজ আমরা মাথা উঁচু করে চলি।" (শেষ লাইনটা বোধহয় এমনই কিছু ছিল)

"অনেকে দিয়েছে সব"এর দলে যদি নাও থাকতে পারি, চলুন না "সবাই দিয়েছে অনেক"এর দলে যোগ দেই, দলে দলে। 

কি করতে হবে আপনাদের? হমমমম। ২/১টা উদাহরণ হয়ত দিতে পারব, কিন্তু বাকিগুলি আপনাদেরই খুঁজে বের করে নিতে হবে। একটা দিয়েই শুরু করি। মুমূর্ষু রোগীর জন্যে রক্ত চেয়ে ফেইসবুক'এ রিকোয়েস্ট পোস্ট নিশ্চয়ই আপনারা সবাই কখনো না কখনো দেখেছেন। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত রক্ত দিয়েছেন, কেউ হয়ত স্টেটাসটা শেয়ার করে অন্যদের জানিয়েছেন, আবার কেউ হয়ত ইগনোর করেছেন এই ভেবে যে যেহেতু কমন গ্রুপ, ব্লাড নিশ্চয়ই ম্যানেজ হয়ে যাবে। এবার একজনের কথা বলি যে কিনা "অনেকে দিয়েছে সব"এর দলের একজন যোগ্য দাবিদার। রোজার মধ্যে আমার এক বড়ভাইয়ের জন্য রক্ত প্রয়োজন। আমি ফেইসবুক'এ রক্ত চেয়ে স্টেটাস দিলাম। ৫ মিনিটের মধ্যে ৫ জন ইনবক্স করলো, "ভাইয়া, শুভ'কে চেনেন? ওকে বলেন, ও রক্ত ম্যানেজ করে দিবে। আমরাও বলছি ওকে।" শুভর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আরিফ ভাই, ঘটনাটির ৫/৬ দিন আগে। ১০ মিনিটের মাথায় শুভ ইনবক্স করলো, "ভাইয়া, আমি শুভ, টেনশন করবেন না, রক্ত ম্যানেজ হয়ে যাবে।" তারপর ম্যাজিকের মত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ৫ জন ডোনার যোগার হয়ে গেল। খেয়াল করবেন,  দিনটা ছিল রোজার মধ্যে, ইউজুয়ালি রোজার মধ্যে অনেকেই কিন্তু রক্ত দিতে চায় না। এরপর থেকে আমি আর আরিফ ভাই প্রায়ই শুভর সাথে যোগাযোগ করি, ওর রক্ত যোগার করার গল্প শুনি। পরিচয় হয় লিটা নামের একটা মেয়ের সাথে, এক যুগের বেশি সময় ধরে মেয়েটা চেনা-অচেনা মানুষের প্রয়োজনে রক্ত যোগার করে দিচ্ছে।  ভালো লাগে ওদের গল্পগুলি শুনতে। কত মানুষের দোআ পায় ওরা, আর কি লাগে, বলেন? 

শুভ আর লিটা কিছুদিন আগে আমাকে আর আরিফ ভাইকে বলল, "ভাইয়া, এভাবে আর পারছি না। প্রতিদিনই ১০টা, ১৫টা রিকোয়েস্ট আসে। এত ডোনার কোথায় পাব বলেন? কিছু একটা করেন।" আসলেই তো, ওরা কয়েকটা মাত্র ছেলেমেয়ে এত বড় দায়িত্ব কিভাবে পালন করবে। বাই দা ওয়ে, কেনই বা করবে? ঠ্যাকাটা কি ওদের একার নাকি? নাকি অভা টাকা পায় রক্ত ম্যানেজ করে দিয়ে?  

এবার আপনাদের কথায় আসি। কি কি উপায়ে আপনারা সবাই মিলে অনেক কিছু করতে পারেন। 
১। যদি আপনি রক্ত দেয়ার মত উপযুক্ত অবস্থায় থাকেন, তাহলে রক্ত দিতে পারেন। রক্ত দিলে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না। 
২। "রক্ত দিলে যে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না" - এই কথাটা আপনার পরিচিতদের বোঝাতে পারেন, যেন তারা রক্ত দিতে আগ্রহী হয়। 
৩। যদি আপনার গ্রুপ আর রোগীর গ্রুপ না মেলে, অথবা আপনি রক্ত দেয়ার মত অবস্থায় নাই, স্টেটাসটা শেয়ার করে অন্যদের জানাতে পারেন।
৪। আমরা যদি একটা সেন্ট্রাল ডোনার ডাটাবেস বানাচ্ছি, তাহলে তার জন্য বেশি বেশি ডোনার যোগার করে দিতে পারেন। 

অনেক বেশি সময় ব্যয় হবে এ কাজ গুলো করতে? কি মনে হয়? ফেইসবুক'এ নাকি এখন কয়েক লক্ষ বাংলাদেশী (নাকি কয়েক মিলিয়ন); রক্তের মত একটা জিনিস ম্যানেজ করা কি আসলেই কোনো বড় ব্যাপার? আমার তো মনে হয় না। কি পাবেন এই কাজটি করে? একটা মানুষের জীবন বাঁচাতে পারবেন হয়ত। ইঁদুর-বিড়াল না কিন্তু - আমি মানুষের কথাই বলছি। যে কিনা আরো বাবা কিংবা মা, ভাই কিংবা বোন, সন্তান কিংবা স্বামী বা স্ত্রী। কত বিশাল একটা কাজ করে ফেলতে পারবেন, ধারণা করতে পারছেন? আরেকটা জিনিস হবে তখন, শুভ-লিটা'রা তখন আর নিজেকে একা ভাববে না। অনেক সাহস পাবে ওরা তখন, আরো উত্সাহ নিয়ে ১০০/২০০ ব্যাগের প্রয়োজনেও ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করবে না। একবার ভাবুন তো, এমন কয়েক'শ শুভ-লিটা যদি কোমর বেঁধে নামে দিন বদলানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে, আর সাথে যদি পায় আপনাদের সবাইকে - কত শত সমস্যা তো এক তুড়িতেই উড়ে যাবে। 

ওদের মত অনেকেই রক্ত নিয়ে কাজ করছে। আরো অনেকে আরো হাজারটা ইস্যু নিয়ে নিজ নিজ ক্যাপাসিটিতে কিছু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই ওরা হতাশ হয়ে যাচ্ছে, ডানে-বায়ে কাউকে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছে। কত বড় ক্ষতি হচ্ছে ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায়, ভাবতে পারেন? একা একা কি মিছিল হয় রে ভাই? আর বিশাল মিছিল না হলে কে কবে পেরেছে নতুন দিন আনতে? 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

"যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে॥"


শুভ'রা জেদ করেই একলা চলা শুরু করেছিল। ওদের ডাক আমরা শুনব কি শুনব না - সেই ডিসিশনটা আসলে আমাদেরই নিতে হবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন