১.
মোবাইল ফোনের ভাইব্রেশনে ঘুম ভাঙ্গলো নানুর।
ফজরের নামাজ পড়ে শুয়েছেন, ঘুমটা তাই এখনো কাচা। মোবাইলের স্ক্রিনে দেখলেন সকাল ৭টা বাজে। এত সকালে কে আবার এসএমএস করলো!
"প্রিয় রাহিলা খাতুন, আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার বড় মেয়ে রওশন আরা বেগম রুনু'র ট্রেন স্টেশনে পৌঁছবে। স্টেশনে উপস্থিত হয়ে আপনার মেয়েকে রিসিভ করার জন্য অনুরোধ করছি।"
কলিজার মধ্যে ধ্বক করে উঠলো নানুর। কি বলে এসব? এত তাড়াতাড়ি রুনু'র ট্রেন ক্যানো আসবে? নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে কোথাও।
পাশে ঘুমিয়ে থাকা নানাভাই'এর মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখেন সেখানেও একই এসএমএস।
"প্রিয় ফজলুল হক, আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার বড় মেয়ে রওশন আরা বেগম রুনু'র ট্রেন স্টেশনে পৌঁছবে। স্টেশনে উপস্থিত হয়ে আপনার মেয়েকে রিসিভ করার জন্য অনুরোধ করছি।"
ধাক্কা দিয়ে নানাভাইয়ের ঘুম ভাঙান নানু - "এই রুনুর বাবা, ওঠো তাড়াতাড়ি। রুনু আসতেসে। স্টেশনে যেতে হবে, জলদি করো।"
নানাভাই চোখ কচলে বলে "কি বলতেসো এসব? রুনু? আমাগো রুনু? ও এত তাড়াতাড়ি আসবে ক্যানো? বয়স হইসে কত ওর? সেদিন না মাত্র বিয়া দিলাম!!!"
নানু ততক্ষণে রেডি হওয়া শুরু করে দিয়েছেন - "কথা কম বলে ওঠো তো। মেয়ে'র ট্রেন পৌছানোর আগেই স্টেশনে পৌঁছতে হবে। নাহলে মেয়ে আমার খুব ভয় পেয়ে যাবে।"
২.
আম্মা কিছুই বুঝতে পারছেন না। একদমই অন্যরকম একটা ট্রেনে বসে আছেন তিনি। সবকিছুর রং সাদা, কেমন যেন আভা-আভা সাদা, যেন আলো বের হচ্ছে। ট্রেনের পু-ঝিক-ঝিক শব্দটাও জানি কেমন সুরেলা, খুব মিহি। হালকা ভলিউমে রবীন্দ্র-সংগীত বাজছে। আশেপাশে আরো কিছু মানুষ বসে আছে, কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।
একটু আগেও আম্মার মন খুব খারাপ ছিল। আসার আগে কাউকেই কিছু বলে আসতে পারেননি। আব্বাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল - কিছুই তো জানে না এই ভোলাভালা-উদাসীন মানুষটা। নিজের শার্ট কই থাকে, টুথব্রাশ কই থাকে, ওষুধ কোনটা খেতে হবে - কিচ্ছু জানে না লোকটা। ছেলে-দুইটাকেও তো ঠিকঠাক মত কোনকিছু বলা হলো না। জয়ী-জীয়ন থাকবে কিভাবে? স্কুল থেকে ফিরেই তো জয়ীর দাদীর কাছে আসতে হত! এখন কি করবে মেয়েটা? বুকের মধ্যে চাপ-চাপ ব্যথা হচ্ছিল আম্মার।
কিন্তু হঠাত করেই কেন জানি মন খারাপটা চলে গেল। হঠাত খেয়াল হলো শরীরে কোনো কষ্ট হচ্ছেনা আর। গলায় হাত দিয়ে দেখলেন যন্ত্রনাদায়ক টিউবটা আর নাই। কাশিটাও হচ্ছেনা। অদ্ভূত একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরছে তাকে। মনে হচ্ছে, ট্রেনটা যেখানে থামবে, খুব ভালো কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য।
৩.
প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালো সাদা ট্রেনটা।
আম্মার সাথে কোনো লাগেজ নাই। দরজা পর্যন্ত হাঁটতে গিয়ে দেখল - বাহ্, হাঁটতেও কোনো কষ্ট হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছে; অনেক ফুরফুরে লাগছে। দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি দিলেন আম্মা।
অনেক ভীরের মধ্যে দেখেন নানাভাই আর নানু ট্রেনের প্রতিটা জানালায় উঁকি দিয়ে কাকে যেন খুঁজছেন। নানাভাই আর নানু দুজনই অনেক ফিট - নানু সুন্দর একটা জামদানি শাড়ি পরা, নানাভাই তুষার-সাদা একটা পাঞ্জাবি - ঝলমল করছেন দুজনই। আম্মা শিশুর মত আনন্দে চিত্কার করে ওঠেন -
"আব্বাআআআ, আম্মাআআআ ... এই যে আমি, এই যে আমি।"
নানাভাই-নানু দৌড়ে আসেন, আম্মা'কে জড়িয়ে ধরেন। তিনজনের চোখেই খুশির অশ্রু। আম্মা নানাভাইকে দেখলেন ৩৬ বছর আর নানুকে ১৩ মাস পর। সে কি বাঁধভাঙ্গা আনন্দ তিনজনের।
নানাভাই আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন "মা রে, তুই এত্তো বড় হইলি কবে? বড় হইসস ঠিকই, কিন্তু একদমই আগের মত সুন্দর আসোস। আর সবাই কেমন আসে রে? সব ভালো তো?"
নানু আম্মাকে একপ্রকার কেড়ে নিয়েই বললেন "সব কথা পরে হবেনে। আগে বাসায় চল। নাস্তা কর, রেস্ট নে। এখানে কোনো কষ্ট নাই, অসুস্থতা নাই। দেখ্তাসোস না, আমি কেমন ইয়াং হয়ে গেসি! তোর মামা-খালা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, বাবলু, কেশব বাবু - সবাইরে ফোন দিসিলাম। সবাই বাসায় আসতেসে তোরে দেখতে। কইসে - তোর হাতের পোলাউ খাইবো। বুঝ অবস্থা, মাইয়াটা আইতে পারলো না, তার আগেই রান্নার ফরমায়েশ শুরু হয়ে গেসে ..."
৪.
হাসতে হাসতে আর বকর-বকর করতে করতে আম্মা নানাভাই-নানুর সাথে স্টেশন থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।