বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

খেলা


খেলা





আব্বা ছিলেন ওয়ারী ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট - যখন আমি ক্লাস নাইন-টেনে পড়তাম। ফুটবল লীগের সীজন-পাশ পেতাম। ভিআইপি পাশ। আমার বন্ধু ঠাকুরও সীজন পাশ পেতো। আমরা দুইজন ছিলাম মোহামেডানের খাস সাপোর্টার। লিগে মোহামেডানের কোনো খেলা বাদ দিতাম না; যেসব খেলায় আবাহনীর হারার চান্স থাকতো; আশায় বুক বেঁধে আমরা সে খেলাও দেখতে যেতাম। মোহামেডান জিতলে হাসি মুখে বাসায় ফিরতাম; মহা আনন্দে রাতের খবর দেখতাম, সকালে উঠেই পেপার পড়তাম - বারবার খুশি হতে চাইতাম। সেইম ঘটনা ঘটতো আবাহনী হারলে। আবার ঠিক উল্টাটাও কিন্তু ঘটতো; মোহামেডান হারলে কারো সাথে কথা না বলে মেজাজ খারাপ করে রুমে ঢুকে ঘুম দিতাম। দুনিয়া-দারি অসহ্য লাগতো।

অথচ, এই জেতা-হারা কোনকিছুর সাথেই আমার জীবন, ক্যারিয়ার, পরিবার, দেশ, রাষ্ট্র, ধর্ম - কোনকিছু জড়িত ছিল না। সেই উত্তেজনা, ভালো লাগা, খারাপ লাগা - সব ছিল ঠিক সেই মুহুর্তের একটা অনুভূতি। এর বেশি কিছুই না। 

গত কয়েক মাসের সবকিছুকে কেন যেন সেই ফুটবল লীগের মত মনে হচ্ছে। কেউ এখানে কট্টর আওয়ামী, কেউ কট্টর আওয়ামী-বিরোধী; (বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি - এরা সবাই আসলে আজকে ওই "আওয়ামী-বিরোধী" দলেরই সদস্য). সেই মোহামেডান-আবাহনীর মতই; দল এখানেও দুইটাই। এবং ঘটনাও একই টাইপ; পর পর কয়েক খেলায় হয়তো আওয়ামিলিগ জিতলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলো, জামাত খেদাতে বুদ্ধিমানের মত গুটি চাললো, সেই সাথে বিএনপি একের পর এক গাধামি করেই গেল - আহ, আওয়ামী ফ্যানরা হেভি খুশি হলো। কিন্তু  হঠাতই  আবার তারা পচা শামুকে পা কেটে ফেলল, চলন্তিকার মত দলের কাছে গো-হারা হারল। ব্যাস, সাথে সাথে আওয়ামী-বিরোধী প্যানেল চান্স পেয়ে গেল, তাদের খুশি তখন দেখে কে? তাফাল্লিং পুরা অন্য লেভেলে, পুরাই লম্ফ-ঝম্প। কিন্তু সেই লম্ফ-ঝম্প'ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না; পচা শামুকের সাথে যে তাদেরও অনেক প্রেম; পা কাটাতেই যেন তাদের জীবনের সার্থকতা!

প্রগতিশীল আরেক দলের জন্ম হয়। তারা ভাবে, নাহ, এই দুই দলের কাউকেই সাপোর্ট করব না। ব্রাদার্স ইউনিয়ন আসলে ভালো দল, ঘাউরা আছে, বড় দুই দলের পিছনেই আঙ্গুল দেয়ার সাহস আছে। লেট্স সাপোর্ট ব্রাদার্স। কিন্তু এই চিপা, আরো করুন চিপা। বড় দুই মোড়ল যেই দেখে, ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা অঙ্গুলি চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে, দু'জন তখন গোপনে গলাগলি ধরে দেয় ব্রাদার্সের টুউউউট করে। (ব্লগার আর ব্রাদার্স, দুইটাই তো দেখি ব দিয়ে শুরু; কাকতালীয়, নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার)

লেখার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এই দুই সিচুএশন'এর মিল খুঁজে বের করে সবাইকে নির্মল আনন্দ দেয়া না। বরং ঠিক তার উল্টা'টা। 

আমরা সবাই বোকার মত খেলাটাকে এনজয় করছি। গ্যালারিতে বসে দূর থেকে খেলা দেখতে যে মজাটা লাগে, আমরা সেই মজা'টা নিচ্ছি। যখন আমার মনমতো কিছু একটা হচ্ছে, আমরা খুশি হচ্ছি, আশাবাদী হচ্ছি। যখন এমন কিছু হচ্ছে যেটা আমার নজরে অন্যায্য, তখন বিরক্ত হচ্ছি, হতাশ হচ্ছি। বিশ্বজিত মরলে বা  মন্ত্রী সাহেবরা গাধামি করে কিছু আবোল-তাবোল বকলে আওয়ামী-বিরোধী'রা মহা খুশি হয়ে উঠছে - যাক, কিছু পয়েন্ট পাওয়া গেল। আবার জামাতের সাথে সুর মিলিয়ে বিএনপি গান গাইলে নৌকা মার্কার পোয়া-বারো। আমরা জনগণ গ্যালারিতে বসে গলা ফাটিয়ে চিল্লাচ্ছি - রক্ত গরম করে ফেলছি। 

একটু আগে যেটা বলছিলাম; লেখার মূল উদ্দেশ্য এই দুই সিচুএশন'এর মধ্যে মিল খুঁজে বের করা না। বরং অমিল'টাকে চোখের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা। 

আমরা কিন্তু গ্যালারিতে বসে নাই, আমরা মাঠের ঠিক মাঝখানে বসে আছি। খেলার তাপ কিন্তু আমাদের গা'এ লাগছে; আমরা খুন হচ্ছি, ধর্ষিত হচ্ছি, অপমানিত হচ্ছি, লুন্ঠিত হচ্ছি। রাজনীতি জিনিষটা রাজনীতিবিদের জন্য একটা খেলা হতে পারে; আমাদের জন্য না। রাজনীতি কিন্তু ফুটবল লিগ না, রাজনীতির সাথে সবকিছু জড়িত - আমি, আপনি, আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, ধর্ম, ব্যক্তিস্বাধীনতা, আমাদের ভবিষ্যত - সবকিছু। তাই বসে বসে হাততালি বা গালাগালি দিলাম আর আশা করলাম একদিন ঝড় থেমে যাবে ... সরি বস, পৃথিবী এভাবে কখনই শান্ত হবে না। 

ওদের খেলা ওরা খেলতেই থাকবে। বোকা একদল মানুষ যদি ওরা যেভাবে নাচাতে চায় সেভাবে নাচতে থাকে; ওরা তো তা এনজয় করবেই। আপনি-আমি হলেও করতাম; তাই না? 

সিদ্ধান্তটা আসলে আমাদের - ওদের খেলা কি আমরা দেখতেই থাকব?  

গ্যালারী যদি ফাঁকা হয়ে যায়, দল যতোই  শক্তিশালী হোক, লীগ কিন্তু একদিন ঠিকই বন্ধ হয়ে যাবে। (দয়া করে "দল" ও "লিগ" বলতে অন্য কিছু ভেবে নেবেন না)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন